
রুশাইদ আহমেদ: মরহুম কবি আল মাহমুদের নাম বাংলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের শুধু একটি সাদামাটা নাম হিসেবে বিবেচনা করা হলে, তা বাংলার চিরন্তন সংস্কৃতিমনা মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল হবে। কেননা, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্য তথা পদ্যে বাংলাদেশের গ্রামবাংলার চিত্র অঙ্কন কিংবা বাংলার চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতি এবং নর-নারীর সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি যে স্বকীয় কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন, তা সেই সময়ে অন্য কেউ হতে পারেননি।
কিন্তু নানা আলোচনা-সমালোচনার কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের তিন-চার দশক পরে আল মাহমুদ ধীরে ধীরে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গণে কেবল এক অবহেলিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। যদিও তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও মরণোত্তর একুশে পদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য; তবুও তাঁর লেখনীর বৃহৎ পরিসর নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গণে আলাপ-আলোচনা, গবেষণা এবং বিশ্লেষণ হয়েছে খুবই নগণ্য মাত্রায়।
বিপরীতে, আমাদের দেশের বাঘা বাঘা সাহিত্য সমালোচক ও গবেষকদের একটা বড় অংশকে সর্বদা শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের কর্ম নিয়েই পড়ে থাকতে দেখা গেলেও, তাঁরা কখনো আল মাহমুদের কাজের দিকে সেভাবে আলোকপাত করেননি।
সেই আঙ্গিক থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে যখন তৎকালীন পূর্ব বাংলার কাব্যভাষায় যেখানে অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য রীতির অনুকরণে লেখালেখির প্রয়াসে আবদ্ধ—ঠিক তখন বাংলা সাহিত্যে কবি আল মাহমুদের আবির্ভাব ঘটে এক স্বতন্ত্র বাংলাদেশি কাব্যভাষা নিয়ে। ঊনসত্তর হাজার গ্রাম সংবলিত বাংলাদেশি ভূখণ্ডের রূপ-রস এবং চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির নানা উপাদান থেকে রসদ সংগ্রহ করে তিনি জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে রাজধানী শহর ঢাকাতে পাড়ি জমিয়ে অনবদ্য সব আধুনিক কবিতা এই জাতিকে উপহার দেন তাঁর লোক-লোকান্তর, কালের কলস আর সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থে।
এই সূত্র ধরে লোক-লোকান্তর কাব্যগ্রন্থের ‘প্রত্ন’ কবিতায় তিনি লেখেন: “…কখনোবা বর্ষার ফলা, কখনোবা পাথরের তীর,/ যূথবদ্ধ জীবনের নারীদের অলঙ্কার, আরো—/ এখানে দাঁড়িয়ে তুমি যত খুশি ভেবে নিতে পারো/ তোমার রক্তের পিছে ইতিহাস কতটা নিবিড়।…” যা কবির মধ্যকার ইতিহাসবোধ ও সংস্কৃতিপ্রেমকে ফুটিয়ে তোলে। একই গ্রন্থের ‘তৃষ্ণার ঋতু’ কবিতায় আল মাহমুদ বাংলার যান্ত্রিক নগরজীবনের দৃশ্য আঁকতে গিয়ে বলেন: “…মায়ের দেহের মতো চিরচেনা এই সে শহর।/ জলসত্র খুঁজেছি তো পাইনি সে কুম্ভভরা জল/ পাইনি মেঘের মূর্তি যার পায়ে বেজে ওঠে মল/ বৃষ্টির শব্দের মতো, যার হাসি কাঁপায় প্রহর।…”
আবার, ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছে তুমুল লোকায়ত প্রকৃতিনির্ভর বাংলার আপামর জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনচিত্র, ঐতিহ্য ও নর-নারীর চিরায়ত সম্পর্কের যে আখ্যান তুলে ধরেছেন কবি আল মাহমুদ, তা অন্য কোনো কবি এতটা নিগূঢ়ভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি। লোকজ উপাদানের নিদর্শনবাহী এই ধরনের কাব্য খুব কমই বাংলা কবিতায় আছে।

উদাহরণস্বরূপ তিনি লেখেন: “…এ কোন কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি/ দরবিগলিত হয়ে ছলকে যায় রাত্রির বরণ,/… শরমিন্দা হলে তুমি, ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে/ মুছে দেব আদ্যাক্ষর, রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।/ বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত করো কলাবতী/ জানতো না যা বাৎসায়ণ, আর যত আর্যের যুবতী।/…” একই কবিতায় তিনি আরও লেখেন: “…মাৎসান্যায়ে সায় নেই, আমি কৌম সমাজের লোক/ সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে/ কোনো সামন্তের নামে কোনোদিন রচিনি শোলোক/ শোষকের খাড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের ’পরে।/… যে বংশের ধারা বেয়ে শ্যাম শোভা ধরেছো, মানিনী/ একদা তারাই জেনো গড়েছিল পুন্ড্রের নগর/ মাটির আহার হয়ে গেছে সব, অথচ জানিনি/ কাজল জাতির রক্ত পান করে বটের শিকড়।…”
এখানে, প্রাচীন বাংলার নারীদের ঐতিহ্যবাহী পরিধেয় নীলাম্বরের উপমা উপস্থাপন, বাঙালি কৌম বা জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ, আদি আর্য-অনার্যের প্রসঙ্গ টানা—সবই আল মাহমুদের এই বদ্বীপের প্রতি প্রেমানুভূতির বহিঃপ্রকাশ। একইসঙ্গে, নিজেকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সদস্য দাবি করে মাৎসান্যায়ের প্রতি সায় না দিয়ে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে উন্নত মস্তকে শাসকশ্রেণীর হুমকিকে নাকচ করাও তাঁর অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে আপসহীনতার সাম্যবাদী বৈশিষ্ট্যকে বহন করে। যা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই বৈশিষ্ট্য।
পাশাপাশি, এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সমকালীন চিহ্নগুলোও আল মাহমুদের সাহিত্য চর্চার অন্যতম পাথেয়। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ পেরিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত দেশের জন্মগ্রহণের পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের একটা অংশ হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশের) মানুষদের ওপর শোষণ ও নিপীড়নের মাত্রা যত বাড়তে থাকে, তত এই অঞ্চলের কবিরা কবিতা ও সাহিত্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফূরণ ঘটাতে শুরু করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে যখন পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার মানুষ রাজপথে নেমে আসেন, তখন আল মাহমুদ লেখেন: “ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/ দুয়োর বেঁধে রাখ!/ কেন বাঁধবো দুয়ার জানালা/ তুলবো কেন খিল?/ আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ ফিরবে সে মিছিল!” (ঊনসত্তরের ছড়া-১)। যা একইসঙ্গে তাঁর দেশপ্রেমিক ও প্রতিবাদী মননের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে।

একইভাবে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি লেখেন: “ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/ বরকতেরই রক্ত।/… প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে/ ছড়াও ফুলের বন্যা/ বিষাদগীতি গাইছে পথে/ তিতুমীরের কন্যা।/ চিনতে না কি সোনার ছেলে/ ক্ষুদিরামকে চিনতে?/ রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে/ মুক্ত বাতাস কিনতে?/…প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে,/ বাংলা আমার বচন, আমি/ জন্মেছি এই বঙ্গে।” (একুশের কবিতা) এই কবিতাংশে একইসঙ্গে তিতুমীরের কন্যা এবং ক্ষুদিরামের আত্মাহুতির অনুষঙ্গ উল্লেখ করায় জাতীয়তাবাদী চেতনার পাশাপাশি কবি আল মাহমুদের অসাম্প্রদায়িক মননেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
তবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে প্যারাডাইম শিফটের মতো কবি আল মাহমুদের চেতনায় আসে কিছু পরিবর্তন। এ যাবত, সাম্যবাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে কাব্য রচনায় রত থাকলেও, ১৯৭২ সালের পরে দেশের নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দৈনিক গণকন্ঠ-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ে সরকারবিরোধী লেখালেখির দায়ে কারান্তরীণ হন তিনি। তখন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো বিশ্বের জনপ্রিয় ধর্মগ্রন্থগুলো পাঠ করা শুরু করেন তিনি। ফলে জেল থেকে বেরিয়েই তাঁর কাব্য সাধনায় ঘটে আমূল বিপ্লব। বাঙালি মুসলমানের সর্বজনবিদিত পরিচয়কে ধারণ করে তিনি হাজির হন মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না এবং বখতিয়ারের ঘোড়া নিয়ে।
মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো গ্রন্থের প্রাচীর থেকে কথা কবিতায় তিনি লেখেন: “কে যেন প্রাচীর থেকে কথা বলে, জোসেফ, জোসেফ!/ রাজার স্বপ্নের মানে বলেছিলে তুমি সেই লোক?/ না আমি জোসেফ নই, না। জানি না ফ্যারাও কে, স্রেফ/ নিজেরই স্বপ্নের দাগে লাল করে রেখেছি দুচোখ।”
এখানে, জোসেফ হলেন ইসলাম ধর্ম মোতাবেক নবি ইউসুফ আঃ। তিনি জীবদ্দশায় একবার মিসরীয় বাদশার স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর মতোই কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করায়, কেউ একজন কবিকে হয়তো জিজ্ঞেস করেন তিনিই স্বপ্নের ব্যাখ্যাদাতা কি-না। জবাবে তিনি নেতিবাচক উত্তর দিলেও, আদতে এই শ্লোকে তিনি নিজেকে নবির সেই অনুসারীদেরই একজন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন স্বপ্নের দাগে চোখ লাল করে রাখার অনুষঙ্গ টেনে। আবার, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো কবিতায় তাঁর পৃথিবীর শেষ ধর্মগ্রন্থ হাতে উঠে দাঁড়ানোর উপমা, বখতিয়ারের ঘোড়া কবিতায় বখতিয়ারকে আল্লাহর সেপাই বলে উল্লেখ, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না কবিতায় কাঁচা পেঁয়াজ না খেয়ে প্রার্থনায় না যাওয়ার কথা, সবই তাঁর চেতনায় তুমুল বদল আসার পরিচায়ক।
কিন্তু কবির এই বদল নিয়ে সাহিত্যাঙ্গণে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয়। অথচ, আল মাহমুদের চেতনা পাল্টে গেলেও, তাঁর লেখনীতে কবিত্বশক্তির ছাপ ছিল আগের মতোই প্রখর। এ কারণে, তাঁকে অধ্যয়ন করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যেতে পারে না।
আমাদের মনে রাখা উচিত যে, চতুর্দশ শতাব্দীতে রাঢ়, বরেন্দ্র, দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার বাসিন্দাদেরকে বাঙালি জনগোষ্ঠী হিসবে প্রতিষ্ঠিত করা সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহও ছিলেন একজন বাঙালি মুসলমান। সুতরাং, আল মাহমুদ কোনো ভ্রান্ত পরিচয়কে ধারণ করেননি।
বরং, তাঁর লেখনীতে একাধারে প্রাচীন বাঙালির যাপিত জীবনের কথা, ঔপনিবেশিক আর পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার ঘূর্ণায়মান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জনআকাঙ্খার কথন স্বাপ্নিকভাবে কাঠামোবদ্ধ হয়ে উঠেছে। এমনকি, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও আল মাহমুদের কবিতা মানুষের মুখে এবং গ্রাফিতিতে পাওয়া গেছে। যা কাজী নজরুল ইনস্টিটিউট কিংবা আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতো একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে তাঁর রচনাকে অ্যাকাডেমিকভাবে বিস্তর অধ্যয়নের জোর দাবি জানায়। কেননা, স্বাধীন, সার্বভৌম এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে আল মাহমুদকে পাঠের কোনো বিকল্প নেই।
লেখকঃ রুশাইদ আহমেদ একজন কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। দৈনিক বঙ্গচিত্র-এ বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত।
আরইউএস
রুশাইদ আহমেদ 






















